শিল্পী চূনী লাল দেওয়ান

প্রথমেই বলে নিই আমি আঁকিয়ে, লেখক নই। লেখার ক্ষেত্রে যে শব্দগত, ভাষাগত ও ব্যাকরণিক দক্ষতা থাকা দরকার কোনটাই আমার নেই। চারুকলা ইনষ্টিটিউটে এম. এফ. এ শেষ পর্বে বাধ্যতামূলক চারুকলা সম্পর্কিত একটি অভিসন্দর্ভ পত্র জমা দিতে হয়। আমার অভিসন্দর্ভ পত্রের বিষয় ছিল — ‌‍‘চাকমা জাতির চিত্রকলা ও তার বিকাশ’ যা অনেকটা গোজামিল আকারে সমাপ্ত করেছি। ‘চাকমা জাতির চিত্রকলা ও তার বিকাশ’ বিষয়টি জটিল যা দীর্ঘ গবেষণা ব্যতীত লিখতে যাওয়া মানেই বিতর্কে জড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু সময় সংক্ষিপ্ততার কারণে সেই সুযোগ আমি পাইনি। যা হোক পত্রটি জমা দেওয়ার পর দেখলাম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মন্ডলীর কাছ থেকে কিঞ্চিৎ প্রশংসা এসেছে। যদিও পত্রে তথ্যগত বহুদিক অসমাপ্ত রয়েই গেছে। অভিসন্দর্ভ পত্রে আমি শিল্পী চূনী লাল দেওয়ানকে চাকমা জাতির প্রথম আধুনিক চিত্রশিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করেছি।

তিনি শুধু চিত্র শিল্পী নন, একজন ভাষ্কর, কবি ও গীতিকারও বটে। এ লেখায় আমি তাঁর বংশপরিচয়, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন এবং শিল্পকর্মের দিকটি উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। আমরা তাঁর সম্পর্কে খুব বেশী জানি না। কারন তিনি এমন সময় উজ্জ্বল জ্যোতিস্কের মত হঠাৎ জ্বলে উঠেছিলেন সে সময় চাকমা বা জুম্ম সমাজ ছিল শিক্ষার অন্ধকারে আচ্ছন্ন। কজনইবা শিক্ষার আলো পেয়েছিলেন সে সময়। চার কলা বা শিল্পকলার সম্পর্কে ধারনা তো একেবারে কল্পনার বাইরে। ঠিক এমনি একটা সময়ে ৩রা ফেব্রুয়ারী, শুক্রবার, ১৯১১ সালে খাগড়াছড়ির পার্বত্য জেলার অন্তর্গত দীঘিনালা থানায় শিল্পী চুনী লাল দেওয়ানের জন্ম। সেই সময় রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিন পার্বত্য জেলাকে একত্রে বলা হত পার্বত্য চট্টগ্রাম (Chittagong Hill Tracts)। তার পিতা শশী মোহন দেওয়ান ছিলেন পুলিশ অফিসার (এস, আই) এবং যথাক্রমে ৬১ নং মাইছছড়ি মৌজা ও ৬০ নং ছয়কুড়িবিল মৌজার হেডম্যান বা মৌজা প্রধান।

৬০নং ছয়কুড়িবিল মৌজার অন্তর্গত নানিয়ারচরের বাজার চৌধুরীর দায়িত্বও তাঁর উপর বর্তায়। একদিকে পুলিশ কর্মকতা আবার অন্যদিকে মৌজা প্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবার সুবিধার্থে তিনি পীতাম্বর মূহুরী খীসা নামের এক বিশ্বস্ত দক্ষ এবং জ্ঞানী লোকের মাধ্যমে তাঁর মৌজার জমি-জমা সংক্রান্ত কাজ কর্ম, খাজনা আদায় এমন কি গ্রাম্য মামলা মোকদ্দমা, সালিশ পর্যন্ত চালাতেন বলে জানা যায়।

শশী মোহন দেওয়ান উত্তরাধিকার সুত্রে যথাক্রমে ৬১ নং মাইছছড়ি মৌজার ও ৬০ নং ছয়কুড়িবিল মৌজার প্রধান হন। তাঁর বাবা অর্থাৎ চুনী লাল দেওয়ানের পিতামহ নীলচন্দ্র দেওয়ানও ছিলেন উল্লেখিত দুইটি মৌজার প্রধান বা হেডম্যান। শশী মোহন দেওয়ান দুইবার সংসারী হন। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর নাম ছিল নয়ন তারা দেওয়ান। তাঁর গর্ভে তিন ছেলে। প্রতুল দেওয়ান, পান্নালাল দেওয়ান ও চুনী লাল দেওয়ান। চূনী লাল দেওয়ান সর্বকনিষ্ঠ। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর নাম ছিল বিশ্বলতা দেওয়ান। তাঁর গর্ভে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। সরোজ কুমারী দেওয়ান, অমরাবতী দেওয়ান, হীরালাল দেওয়ান ও মনীলাল দেওয়ান।

চূনীলাল দেওয়ানের জন্ম দীঘিনালায় হলেও তাঁর পূর্বপুরষদের আদি নিবাস ছিল রাঙ্গামাটি শহর থেকে আঠার কিলোমিটার উত্তরে বড়াদম নামক গ্রামে। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ দেওয়ার ফলে উক্ত গ্রামটি জলমগ্ন হয়। এ গ্রামটি ৬১ নং মাইছছড়ি মৌজার অন্তর্গত ছিল। গ্রামটি জলমগ্ন হওয়ার ফলে চুনীলাল দেওয়ানের পরিবার নানিয়ারচরে স্থানান্তরিত হয়। তখন থেকেই অদ্যাবধি তাঁর পরিবার পরিজন নানিয়াচরেই মূল বসবাস। সময়ের পরিক্রমায় অনেকেই আবার পেশাগত কারণে রাংগামাটিতে স্থানান্তরিত।

চূনী লাল দেওয়ানের জন্মের পরপরই তাঁর মাতা মারা যান। তিনি জনৈকা ধাত্রীর হাতে লালিত পালিত হন। তাঁর মাতা যখনই নিশ্চিত হন যে তাঁর আর বাঁচার আশা নেই তাই জনৈকা ধাত্রীকে শিশু চূনী লালের লালন পালনের দায়িত্ব দিয়ে যান। যতদুর জানা যায়, জনৈকা ধাত্রী চূনী লাল দেওয়ানকে বার বছর পর্যন্ত লালন পালন করেন। চূনী লাল ধাত্রীকে বুড়া মা বলে ডাকতেন। যদিও তাঁর নিজেরও আলাদা সংসার ছিল। চূনীলাল দেওয়ানের পিতা ধাত্রীর সংসারের ভরন-পোষনের যাবতীয় খরচ যোগাতেন। ধাত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে শশী মোহন দেওয়ান তাকে বৌদ্ধ তীর্থস্থান বুদ্ধ গয়ায় ঘুরে আসার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বুদ্ধ গয়া থেকে ধাত্রী চূনী লালের জন্য জুতার মৌজা ও অন্যান্য খেলনা জাতীয় জিনিষ নিয়ে এসেছিলেন। পরে চুনী লাল দেওয়ান স্কুলে ভর্তি হলে তারপর জনৈকা ধাত্রী স্ব-সংসারে ফিরে যান ।

ছোটকাল থেকেই ধীরস্থির, ভাবুক প্রকৃতির মানুষ চুনী লাল দেওয়ান ধাত্রীর হাতে লালিত পালিত হলেও তাঁর বাবার স্নেহ মমতার কমতি ছিল না। ইতোমধ্যে তাঁর বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করে দ্বিতীয় সংসারে সন্তানের আগমন ঘটেছে। তাঁকে পড়াশুনার জন্য রাঙ্গামাটি সরকারী হাই স্কুলে ভর্তি করানো হয়। যতদুর জানা যায় তিনি ঐ স্কুলে নবম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন।

শান্ত-শিষ্ট সদাভাবুক প্রকৃতির মানুষ চূনী লালকে সর্বদা আকর্ষন করেছে এ অঞ্চলের পাহাড়ীয়া প্রকৃতি। উচু-নীচু পাহাড়, ঝরনা, অবারিত সবুজের বিরাট সমারোহ প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ মাত্রই তার টান অনুভব করবেই- অন্তর থেকে। এছাড়া এ অঞ্চলের আদিবাসীদের শশব্যস্ত জনপদ তো রয়েছেই। বড়াদম গ্রামের পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে যাওয়া চেংগী নদীর কাউনীদের(বাঁশের চালী বাহক) সারি সারি বাশেঁর চালী ও জেলেদের নৌকা কার না ভাল লাগবে। এমনি একটি মনোরম পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন চূনী লাল দেওয়ান।

ছোটকাল থেকেই ছবি আকার প্রতি চূনী লাল দেওয়ানের রয়েছে প্রচন্ড ঝোক। তেলের উপর কাগজ চুবিয়ে বই থেকে তিনি ছবি নকল করতেন। এভাবে তাঁর ছবি আকাঁ হাতে কড়ি। এছাড়া তাঁর পিতা শশী মোহন দেওয়ানও তাঁকে বার বার প্রেরণা যোগাতেন। অবশ্য তাঁর পিতার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে পুলিশ অফিসার অথবা আইন বিষয়ে পড়াবেন। কিন্ত ছেলের ছবি আকাঁর প্রতি প্রচন্ড ঝোক থাকায় আর্ট স্কুলে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।

১৯২৮ সালে জুলাই মাসে চূনী লাল দেওয়ান জনৈক আত্মীয়ের সাথে আর্ট কলেজে ভর্তির উদ্দেশ্যে কলকাতা রওয়ানা হন। চূনী লাল দেওয়ানের দ্বিতীয় পক্ষে স্ত্রী বসুন্ধরা দেওয়ানের বলেন, কলকাতা আর্ট কলেজে (চৌরজ্ঞী আর্ট স্কুল) ভর্তির উদ্দেশ্যে যাত্রাকালীন চূনী লাল দেওয়ানের পিতা তাঁকে সে সময় ৫০০ (পাঁচশত) টাকা দিয়েছিলেন। তিনি প্রাচ্যকলা (ওরিয়েন্টেল ডিপার্টমেন্ট) বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে তাঁর বাবা আর কোন টাকা পাঠাননি। তিনি প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে প্রাপ্ত বৃত্তি এবং কমার্শিয়াল কাজ করেই তাঁর পড়াশুনা চালিয়ে যান। প্রায় ছয় বছর একটানা অধ্যয়ন করার পর ১৯৩৪ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের শিল্পান্দোলনের অগ্রপথিক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ১৯৩২ সালে তৎকালীন আর্ট স্কুলে সুকুমার কলা (ড্রইং এন্ড পেইন্টিং) বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৩৮ সালে কৃতিত্বের সহিত পাশ করে বের হন। দেখা যাচ্ছে চূনী লাল দেওয়ানই পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের প্রথম অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত চিত্রশিল্পী। তিনি শিল্পাচার্যের চেয়ে চার বছরের সিনিয়র ছিলেন। আর্ট স্কুলে পড়াকালীন চূনী লাল দেওয়ানের সাথে শিল্পাচার্যের পরিচয় ছিল কিনা তা জানা যায়নি। কারণ তাঁরা একই আর্ট স্কুলের ছাত্র হলেও ভিন্ন ভিন্ন বিভাগের ছাত্র ছিলেন।

চূনী লাল দেওয়ান ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ঝামেলামুক্ত নিরহংকার মানুষ। কলকাতা আর্ট থেকে ডিপ্লোমা পাশ করে বের হওয়ার পর পরই তাঁর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। যতদূর জানা যায়, তাঁর পিতা শশী মোহন দেওয়ান যখনই চুনীলালকে কলকাতা আর্ট স্কুলে পাঠানোর মনস্থ করেন তখন তিনি ছেলের বিয়ের এ্যানগেজম্যান্ট নিয়েও চিন্তা ভাবনা করেন। তাঁর পিতার ধারণা ছিল চুনীলাল আর্ট স্কুলে অধ্যয়নকালে অন্য বেজাতীয় মেয়ের পাল্লায় পড়তে পারেন। তাই তিনি নিজের আপন বোনের মেয়ে চারবালা দেওয়ানের সাথে চূনীলালের এ্যানগেজ্‌ম্যান্ট করিয়ে রাখেন।

চূনী লাল দেওয়ান আর্ট স্কুল থেকে বের হওয়ার পর পূর্বতন এ্যানগেজ্‌জ্ম্যান্ট অনুযায়ী চার বালা দেওয়ানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য হন। যতদূর জানা যায়, এই বিয়েতে চূনীলাল দেওয়ানের মত ছিল না। অনেকটা পিতার কথায় বাধ্য হয়ে তিনি চারবালা দেওয়ানকে বিবাহ করতে সম্মত হন। তারপরও তাঁদের সংসার সুখে শান্তিতে কাটছিল । তাঁদের দুই ছেলে এবং এক মেয়ে। হঠাৎ একদিন তাঁর সংসারে বিপর্যয় নেমে আসে। চার বালা দেওয়ান হঠাৎ ইহধাম ত্যাগ করে চলে যান। স্ত্রীর বিয়োগের পর চূনীলাল মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লে অনেকটা আত্মীয় স্বজনদের পিড়াপিড়িতে তিনি আবার ১৯৪৬ সালে বসুন্ধরা দেওয়ান নামের একজন সেবিকাকে বিয়ে করেন। (বসুন্ধরা দেওয়ান চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সেবিকা। চুনীলাল দেওয়ানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে তিনি নার্সিং বা সেবিকা. পেশা ত্যাগ করেন। চূনীলাল দেওয়ানের মৃত্যুর পর থেকে তিনি উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্ত ৬০নং ছয়কুড়ি বিল মৌজার হেডম্যান এবং নানিয়ারচর বাজারের বাজার চৌধুরীর দায়িত্বে আজ অবধি কর্মরত।

প্রসঙ্গত, বসুন্ধরা দেওয়ান চাকমা সম্প্রদায়ের প্রথম মহিলা হেডম্যান)। এই মহিয়ষীকে বিয়ে করার পর চূনীলাল দেওয়ানের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। স্বামীর ছবি আঁকা, প্রচার এবং প্রসারে তিনি ব্যাপক অবদান রাখেন। চুনীলাল দেওয়ান ছিলেন প্রচারবিমূখ শিল্পী। যতদূর জানা যায় বসুন্ধরা দেওয়ান স্বামী চুনীলাল দেওয়ানকে বিদেশে পাঠানোর জন্য তৎকালীন জেলা প্রশাসক L. H. Niblet সাহেবের নিকট জোর আবেদন জানান। ষষ্ঠ শ্রেনী পর্যন্ত পড়ুয়া ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে বসুন্ধরা দেওয়ানের আবেদনটি ছিল এরকম- Sir, my husband Artist, Why he is living here (Chittagong Hill Tracts)? You send him out. নিবলেট সাহেব বসুন্ধরা দেওয়ানের কথার গুরত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ছাড়া তিনি নিজেই ছিলেন একজন কলারশিক । নিবলেট সাহেব তাঁর স্ব-উদ্যোগে চূনীলাল দেওয়ানের আঁকা ছবি দেখার পর চুনীলাল দেওয়ানকে আমেরিকায় পাঠানোর জন্য সবরকম ব্যবস্থা করেছিলেন। পরে কেন যাওয়া হয়নি সে প্রসঙ্গে পরে আসব।

চুনীলাল দেওয়ান চল্লিশ দশকে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে অংকন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন আশি টাকা বেতনে । তিনি দুই বছর এই স্কুলে কর্মরত ছিলেন। এই দিকে ৬১নং মাইচছড়ি ও ৬০নং ছয়কুড়ি বিল মৌজার হেডম্যান প্রতুল দেওয়ান (চুনীলালে কনিষ্ঠ ভ্রাতা) প্রতুল দেওয়ান হঠাৎ মৃত্যু বরণ করলে মৌজার হেডম্যানশীপ ও নানিয়ারচর বাজার চৌধুরী পদে শূণ্যতার সৃষ্টি হয়। প্রতুল দেওয়ানের জ্যেষ্ঠ ছেলে প্রনব দেওয়ানকে উত্তরাধিকার সূত্রে এই পদগুলিতে নিয়োগদান করা হয়। বছরাধিক দায়িত্ব পালনের পর তিনি রাজনৈতিক এবং আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় ভারতে পালিয়ে যান । যার ফলে আবারও হেডমান ও বাজার চৌধুরী পদে শূণ্যতার সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন এই পদ শূণ্য থাকার পর শিল্পী চূনীলাল দেওয়ানকে এলাকার জনগণের ভোটের মাধ্যমে হেডম্যান ও বাজার চৌধুরী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। যদিও তাঁর আরেক জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পান্নালাল দেওয়ানসহ আরো অনেকে ঐ পদের জন্য প্রার্থী ছিলেন। জেলা প্রশাসক L. H. Niblet সাহেব জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে ঐ পদে চূনী লাল দেওয়ানকেই নিয়োগ দেন ।

শিল্পী চূনী লাল দেওয়ান ব্যক্তিগত জীবনে সাদা সিদে জীবন যাপন করতেন । বিশিষ্ঠ লেখক, গবেষক শ্রদ্ধেয় ডাঃ ভগদত্ত খীসা যিনি চূনী লাল দেওয়ানকে জীবদ্দশায় খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁর লিখিত চূনী বাবুর জীবনী ভিত্তিক “সেই এক চুনী বাবু” নিবন্ধ থেকে কিয়দংশ আমি এখানে উদ্ধৃত করছি-

“নির্বিরোধী মানুষ চূনী বাবু। কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই। কারো কাছে ধারতেন না এবং কাউকে ধারও দিতেন না। এ নিয়ে একটা বদনাম ছিল তাঁর। বড় একটা বাইরে বেরোতেন না তিনি। খানা পিনা, সামাজিক অনুষ্ঠানেও খুব একটা চোখে পড়ত না। এক ঘরে হয়ে আপন শিল্প ও সংস্কৃতির জগতে বিচরণ করতেন একা। পৈতৃক কিছু জমি জমা ছিল। ওগুলো ভাগচাষ দিয়ে তার গ্রাসাচ্ছাদন চলত। নিতান্ত সাদাসিধে আটপৌরে জীবন বেশী কিছু প্রয়োজন তার ছিল না।

পোষাক পরিচ্ছদে তিনি খুব সংক্ষিপ্ত। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি ঘরের চৌহদ্দিতে কাটিয়েছেন। পড়নে থাকত লুঙ্গি ও গায়ে গেঞ্জি। কদাচিত বাইরে বেরোতে হলে হাফপ্যান্ট ও শার্ট। পায়ে ক্যাভাসের লাল জুতা। উৎসবে আয়োজনে শীতের সময় থাকত ফুলপ্যান্ট আর শার্টের উপর সাদাকালো ডোরাকাটা একটা কোট। বহু পরিচিত সেই কোটটা এখনো আমার চোখে ভাসে৷

প্রায় দিন গ্রামের রাস্তায় বেরোতেন তিনি বিকেল বেলা। ভ্রমনে। একটু হাত পা খেলানো। এ নিয়ে কথা উঠত পাড়ায়। লোকে রাস্তায় চলাফেরা করে প্রয়োজনে। হাটে বাজারে যায়। ক্ষেত খামারে যাওয়া আসা আছে। কিন্তু স্রেফ গায়ে হাওয়া লাগানোর জন্য রাস্তায় হাটা পাড়ার লোকে অহেতুক মনে করত। কিন্তু তিনি ভ্রক্ষেপ করতেন না।

লেখক: ধনমনি চাকমা

তথ্যসূত্র: লামপ্রা