সুহৃদ চাক্‌মা : আরণ্যিক উপমা ও চিত্রকল্পের কবি

ভূমিকা

সুহৃদ চাকমা (১৯৫৮-১৯৮৮) ও তাঁর কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে বিগত বিশ শতকের নব্বই দশকের মাঝপর্বে তাঁর রচিত চাকমা ও বাংলা দ্বিভাষিক কাব্যগ্রন্থ বার্গী’র (১৯৮৭) মাধ্যমে। এটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন রাঙামাটি শহরের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুখেশ্বর চাকমা পল্টু। সুহৃদ চাকমা’র এই দ্বিভাষিক ও তাঁর একমাত্র কাব্যটি সেই সময়ে যেমন, এখনও তেমনি আমাকে বেশ আকর্ষণ করে। তার কারণ, প্রথমত সুহৃদ চাকমার ভাষাচেতনা, দ্বিতীয়ত তাঁর কবিতায় বিধৃত মৌলিক চিত্রকল্প ও উপমা প্রয়োগের গতিবান ধারা।

এক.

ভাষাচেতনার দিক থেকে সুহৃদ চাকমা অগ্রসর মননের অধিকারী ছিলেন। সার্বক্ষণিকভাবে তাঁর অনুভূতিতে ছিল, চাকমা ও বাংলা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত দুটি খুব প্রতিবেশী ভাষা। যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাংলাদেশ ও নিকটস্থ ভারতীয় এলাকায় প্রচলিত। চাকমা জাতির লোকসাধারণ আদিতে তিব্বতি- বর্মী ভাষায় কথা বলতেন। কালের বিবর্তনে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিবেশী চট্টগ্রামী আঞ্চলিক বুলিও চাকমা ভাষার ওপর প্রভাব ফেলেছে। তা সত্ত্বেও চাকমা ভাষা নিজস্ব লিপিতেই লেখা হয়। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহ পৃথিবীর আদি ভাষা-পরিবারের সদস্য। এই ভাষা-পরিবারটি ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায়শই বিবর্তিত হয়েছে। হিন্দি ইংরেজি লাতিন ফার্সি ও রুশ ছাড়াও বিশ্বের অনেক ভাষা এই পরিবারভুক্ত। লক্ষণীয় বিষয় হলো, চাকমা সমাজ মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীভুক্ত হলেও তাদের ভাষা মঙ্গোলীয় ভাষার অন্তর্ভূত নয়। এ ভাষার সঙ্গে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বাংলা অহমিয়া হিন্দি প্রভৃতির একধরনের মিথোষ্ক্রিয়া সাধিত হয়েছে। এই সন্নিকটবর্তিতার কারণে বাংলাভাষীর পক্ষে চাকমা কিংবা চট্টগ্রামী আঞ্চলিক ভাষা জানা-বোঝা খুব একটা আয়াসসাধ্য বিষয় নয়। এছাড়া পার্শ্ববর্তী ভাষাসমূহ টিকে থাকার সংগ্রামের অংশ হিশেবে নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদানের (symbiosis) কর্মটিও আবহমানকাল থেকে সাবলীলভাবেই সম্পাদন করে চলেছে আপনা থেকেই। যেমন : গারো ও হাজং আদিবাসী ভাষা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোকভাষা, মণিপুরী সমাজের বিষ্ণুপ্রিয়া ও মইতই ভাষা ও সিলেট অঞ্চলের লোকভাষা, পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা মারমা ত্রিপুরা চাক ম্রো খুমি লুসাই তনচংগ্যা বম খিয়াং পাংখো ভাষা ও চট্টগ্রামী লোকভাষা, রাজশাহী-নওগাঁ অঞ্চলের লোকভাষা ও সাঁওতাল বা পার্শ্ববর্তী অন্য আদিবাসী ভাষাসমূহ। ওসব অঞ্চলে প্রচলিত ভাষাগুলোতে পরস্পরের চলতি বুলির স্বতস্ফূর্ত জড়াজড়ির ব্যাপারটা এতদিনে খুব সাধারণ বিষয়ের মান্যতা পেয়েছে। বিশিষ্ট লেখক বিরাজমোহন দেওয়ান তাঁর ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ (১৯৬৯) গ্রন্থে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার একটি চিঠির কিয়দংশ উদ্ধৃতি দিয়েছেন। চট্টগ্রামের তৎকালীন কমিশনার জিন বিমস নামক ওই কর্মকর্তা চিঠিটি লিখেছিলেন রাজস্ব বোর্ডের কাছে। তাতে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন : ‘চাকমাগণ অর্ধ বাঙ্গালী। বস্তুত ইহাদের পোশাক-পরিচ্ছদ এবং ইহাদের ভাষাও বাঙ্গালা ভাষার বিকৃত অবস্থা মাত্র ৷ এতভিন্ন চাকমাদিগের উপাধি ব্যতীত নামগুলিও এমন বাঙ্গালী ভাবাপন্ন যে, তদ্বারা ইহাদিগকে বাঙ্গালী হইতে পৃথক করা একরূপ অসম্ভব।’ একই গ্রন্থে বিরাজমোহন দেওয়ান নিজ জবানিতে বলছেন : ‘চাকমা ভাষা মিশ্রিত ভাষা। ইহাতে বাঙ্গালা, সংস্কৃত, আসামী ও মাগধীর প্রাকৃত ছাপ বৰ্ত্তমান। তাহা হইলেও বাঙ্গালা ভাষার সাথে এমন সামঞ্জস্য রহিয়াছে যে, ইহাকে বাঙ্গালা ভাষার অপভ্রংশ বলা চলে। চাকমারাই যে বাঙ্গালীদিগের অধিকতর সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন, ইহাতেই বোঝা যায়।’ (ওই, পৃ. ১১)

আজকের বাংলাদেশে বাংলাভাষীরা প্রধান জনগোষ্ঠী বা বাঙালি জাতি বলে পরিচিত। কিন্তু সুদূর ঐতিহাসিক কালের দিকে দৃকপাত করলে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়, প্রায় চার হাজার বছর আগে আর্য নামের এক যাযাবর জাতি উত্তর ভারতে প্রবেশ করেছিল। তারও প্রায় এক হাজার বছর পরে বৈদিক যুগের শেষদিকে আর্যরা বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়। তবে তাদের এ প্রবেশচেষ্টা নির্বিঘ্ন ছিল না। বাংলা অঞ্চলের আদি বাসিন্দারা সম্মিলিতভাবে তাদের পথরোধ করেছিল। গ্রিক বীর আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সালে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে আফগানিস্তানের অন্তঃপাতী কিছু ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র রাজ্য জয় করে পাঞ্জাবে উপনীত হন। তবে মগধের রাজাদের সামরিক শক্তির গল্প শুনে তাঁর সৈন্যরা বিপাশা নদী অতিক্রম করেনি।’ (কলকাতা, ১৯৮৫, প্রবোধচন্দ্র বাগচী : ‘দেশ-বিদেশের সংস্কৃতি’, পৃ. ২৩, নবার্ক)।

আজকের বাঙালিসহ বাংলা অঞ্চলের ওই আদিবাসিন্দারা সকলেই ছিলেন আজকের ভাষায় ‘আদিবাসী’। তারা নিজস্ব ভৌগোলিক চেতনা দ্বারা উজ্জীবিত ও সংঘবদ্ধ ছিলেন। সেসব জাতিগোষ্ঠীর অনেকগুলোর মিশ্রণে আজকের সংকর বাঙালি জাতিসত্তার উদ্ভব হয়েছে এবং ইতিহাসের নানা ঘাত-প্রতিঘাতময় পালা পেরিয়ে আজকের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। কাজেই সমকালের আদিবাসী চেতনা ও পুরাকালীন বাঙালি চেতনার মেরুপ্রতিম কোনো দূরত্ব তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না বললেই চলে।

দুই.

সুহৃদ চাকমা’র প্রধান কাব্যিক অভিব্যক্তি চাকমা ভাষায় লিখিত ১৯টি কবিতার বাংলা অনুবাদসহ মোট ৩৮টি কবিতার সংকলন ‘বাগী’। ‘বাৰ্গী’ অর্থ যাযাবর হৈমন্তিক পাখি বিশেষ। চাকমা রূপকথা ‘রাধামন-ধনপুদি পালায় এসব সোনালি রঙের বিহঙ্গের উল্লেখ আছে। এখানে কবির উদাসীন মনের ভাবৈশ্বর্যের সঙ্গে সমকাল ও ইতিহাসবোধের বিভিন্ন মনোদৈহিক অবস্থার ছায়াপাত ঘটেছে। সেই সঙ্গে পংক্তিতে-পংক্তিতে অনুভূতিসঞ্জাত প্রাতিস্বিক চিত্রকল্প ও উপমার নিবিড় সৌন্দর্য উছলে ওঠে। এই বক্তব্যের পক্ষে ‘বার্গী’ থেকে কিছু উদ্ধৃতি চয়ন করা যাক :

১ :: ‘… ম’র আওঝর রাঙামাত্যা,

…

আউনমাযর ভুলোংফুল’ খবং-দ্য তিন-তেঙি সান,

দেবংসি সুঘে খবংয়ান দীপক গদত নাজি নাজি উধে

রাধামন-ধনপুদি পালার পোত্যে-আমলর রেঙ’ চাগে। …

(আমার আকাঙ্ক্ষার রাঙামাটি,/ অঘ্রানের কাশফুলের ঘোমটা দেয়া থুথুড়ে বুড়ি; অজানা আনন্দে ঘোমটা দীপক রাগিণীতে নেচে ওঠে/ রাধামন-ধনপুদি পালার শেষপ্রহরের উল্লাসে । “ম’ আওঝর রাঙামাত্যা”, পৃ. ১/২)

…

২ :: কাদিমাষ ফুত্যে সুদোহলার জুমতুগুনোত জুনোপ ফুদিলে

একঝাক সনারঙ মেদোনী-বার্গী উরি যায়

মেঘ সেরে কুওর খবং মুগুচ্যে মোন সান স্ববনত। …

(কার্তিকে সুতোকলি-ফোটা জুমের আঙিনায় জ্যোৎস্না ফুটলে / একঝাঁক সোনালি গর্ভিনী-বার্গী উড়ে যায়/ মেঘের আড়ালে কুয়াশার ঘোমটাপরা পাহাড়ের মতো স্বপ্নে…,। ‘বার্গী’, পৃ. ৩/৪)

৩ :: … পিজেন্দি পাথরত আজেরে পরে পানি নালর গঙানি

মুজুঙে অসাগর জুগ বেতিরিক্যা সাব-চেরা

বেধক্যা-অমকদ কেইয়্যা নাজায়

রাগে-হিংজ্যেয় গোঙেই উধে

তমা’ পুজ হল যুক্কন ৷ …

(পেছনের ঝরনাধারায় পাথরে আছড়ে পড়ে অবিরল বোবাকান্না / সামনে অসংখ্য জোঁক, বিসদৃশ সরীসৃপ / হিংস্র শরীর দোলায় / অন্ধ আক্রোশে ফুঁসে ওঠে/ তোমাদের পূজার হলো আয়োজন …। ‘মোনঘর’, পৃ. ৭/৯)

৪ :: … সেযান কবিতা লেঘানার সুঘ ন-পাং ভালোকভিলোন;

ইক্কো বো-যিয়্যে মিলে যেয়ান্যান পথম পো-পুদানার সুঘ

হারে হারে মেইত পায় । …

(তেমন কবিতা লেখার সুখ পাইনি অনেক দিন;/ একজন বিবাহিত নারী যেমন প্রথম প্রসব বেদনার সুখ/ তিলে-তিলে অনুভব করে। ‘কবিতা ১’, পৃ. ১১/১২)

৫ :: … কুর-কুর সলাবিজি ঝিমিতঝামাত জ্বলিল

তাল-তাল সিগ্রেদ ধুমোয় মেঘ জমেল

কাবিল-কাবিদ্যং আমি বেলুন হোই

আগাঝত উরিলোং

রনলোই কৃষ্ণ ‘নমোতাস ভগবাতো’ জবি-জবি

আমাহ্বান্যে চোগে চেই রলাক-

আমি আগাঝত্তুন তারার পালঙে-সাদস্যে

মুয়ানির মানে মাদেলাং

আর রোদ’ সদক ফুত্তে ন-ফুত্তে জালানি কোদোরর ঝাক

দগিনে-পজিমে উরি যানার মেইত পেলং।

(রাশি-রাশি দীপশলাকা ঝিকিমিকি জ্বলল/ তাল-তাল সিগারেটের ধোঁয়ায় জলদ জমল/ আত্মবিধ্বংসী-করিৎকর্মা আমরা বেলুন হয়ে আকাশে ওড়লাম/ রণ-কৃষ্ণ ‘নমোতাস ভগবাতো’ জপে জপে ছানিপড়া চোখে/ তাকিয়ে রইল/ আমরা আকাশের অনেক দূরে থেকে তাদের পাংশু মুখের ভাষা পড়লাম/ আর ঊষার আলো ফুটতে না-ফুটতে জালালি কবুতরের ঝাঁক/ দক্ষিণে-পশ্চিমে ওড়ে যাওয়া অনুভব করলাম …। ‘এক্কান স্ববনর স্যুররিয়ালিস্টিক পজ্জন,’পৃ. ১৩/১৪)

৬ :: তর লাঙমেয়্যেভরা এগোচ্চো সোজ- সোজ পোচপানা’ ঘুদিত

ম’র লাঙর সেরেনাদ আর সিম্ফনির গৎ হারে যায়

এগোজ’ আবাজে-

পরানী, তর-ম’র দ্বিজনর সিজি-জদন’ উচ্চোর ক্ষেনত । …

(তোমার প্রেমময় ভালোবাসার একুশটা সবুজাভ কক্ষে/ আমার প্রণয়ের সেরেনাদ আর সিম্ফনির সুর হারিয়ে যায়/ একুশটা নিস্বননে-/ প্রেয়সী, তোমার-আমার পরিণয়ের উজ্জ্বল মুহূর্তে …। ৩১ জানুআরি ‘৮২ত স্বপ্নাত্যে রজেয়্যে কয়েক্কো গৎ‍’, পৃ. ১৫/১৬)

৭ :: নিয়ানডারথাল মানেইউন মাত্তল ঘুম আর

আন্দারর আন্দলে লুগি যান;

সোজ মোন আর জুনোপ দোর্য্যাত ম্যামথ ভাজি উধোন-

বল্গাহ্রিঙ’ বেঙাশিং তারার চরি বেরানার নিজেনী দেঘে-দেঃ

‘গভীন দগিন কুজিবল্যা বান্যাছাব’

‘নিশুলীমেয়্যের তারুম বন’

ট্রব্রিয়ান্ড গাভুরীর রগজকোরঙর নাদঘর। …

(নিয়ানড্যারথাল মানবগুলো মাতাল ঘুম আর আঁধারের আড়ালে/ হারিয়ে গেলে;/ সবুজ পাহাড়ে জ্যোৎস্নার প্লাবনে ম্যামথ ভেসে ওঠে—/ বরাহরিণের বাঁকা শিং চারণভূমির নিশানা দেখিয়ে দেয়ঃ/ ‘দখিনের গভীরতম প্রদেশে বেড়ে ওঠা পুরানো জুমের/ রসালো-সতেজ সবজিক্ষেত’/ ‘অসহ্য-আবেগসঞ্চারী বনবাদাড়/ ট্ররিয়ান্ড যুবতীর আলতারঙের নাচঘর … । ‘ম্যামথ’, পৃ. ১৯/২০)

৮ :: … চেরোকেইত নাদংছারা গরুচরা দঙলর

আউনমাযর সাদাঙা সময়,

বেক ফল-ফুল-পাগোরত হীনর আলাবন,

কাবিল ক্যানভাস জনম লয় লঙ্গরখানা,

ভারবো ঘরপাদা;

লঙ্গরখানার উত্তুরে উরন ঝাগে-ঝাগ তেলিবিরাজ

ভারবো-ঘরপাদাত বজত্তি গরন

পালে পাল রগনি শামলক । .

(সবখানে অঘ্রানের গরুঘোরা বিশৃঙ্খল শূন্য / মাঠে সতীন সময়, / সব ফুল-ফল-পাপড়িতে হিমের আলাপন, / জাদুকরিক্যানভাস জনম নেয় লঙ্গরখানা, ঊষর বাসভূমি;/ লঙ্গরখানার ওপরে ওড়ে ঝাঁক-ঝাঁক ফিঙে পাখি/ ঊষর বাসভূমে বাস করে পাল-পাল রক্তচোষা গিরগিটি …। ‘পালোমো’, পৃ. ২১/২২)

৯ :: … কবিতা ম’র দ্বি-ভোরি চানপরত পথ হাদানার পর;

সাঝন্যের জুমতুগুনোত বাক্কো চারিলোই ঘরত ফিরিত্তে

জুম্মবী চোগর লাঙমেয়্যে বিজোল স্ববন;

শরর ফুদপাদর ভিক্ষে মাগন্যের ভিক্ষে থালর অভিযোগ-

কবিতা ম’র নদরকান কাবিল-কধাতারা লাহরের’ লরবুয়ার

এগাগুলির গঙ । …

(কবিতা আমার দ্বিতীয়াদশী জ্যোৎস্নার পথ পেরুনোর আলোর শিখা;/ সন্ধ্যেয় জুমের শীর্ষে কাস্তে হাতে ঘরমুখো / জুম্মবী চোখের স্বপ্নিল ভালোবাসা;/ শহরের ফুটপাতের ভিখিরীর ভিক্ষেপাত্রের অভিযোগ / কবিতা আমার দুঃসাহসী কথামালা, রণক্ষেত্রের অব্যর্থ গুলির নিশানা। ‘কবিতা’, পৃ. ২৩/২৪)

১০ :: … বেলান দুবি যায়-

অসুক আন্দারত অলর হোই মরনর কুক্ষেনুন হিজেব গরে;

অজার বেসদর মরনখলাত শবোন তগায় শবোনীরে

চেরোকিত্যে পঝা লাঝ

দুওরত থিয়েয়্যে অসাগর হারকরা

মুজুঙে এলিঅতর দাঙাযেয়্যে জুম।

(সূর্য ডোবে−/ অসহ্য অন্ধকারে নিশ্চুপ হয়ে বীভৎস প্রহর গোনে / খোলা বধ্যভূমে শকুন খোঁজে শকুনিরে/ চারিধারে পচা শব/ দুয়ারে দাঁড়িয়ে অসংখ্য কঙ্কাল/ সুমুখে এলিয়টের পোড়োজমি …। ‘বাঝি থেবার অসুখ্যা আঝায়ানি, পৃ. ৩৯/৪১)

তিন.

১ নম্বর উদ্ধৃতিতে শীতের আগমনের ঠিক আগেকার একটি প্রাকৃতিক দৃশ্য অঙ্কিত হয়েছে অক্ষরের অপূর্ব রঙে। কাশফুল দোলানো অঘ্রানের ওই সময়টাকে কবি একটি দারুণ চিত্রকল্পে বিদ্ধ করেছেন : “ম’র আওঝর রাঙামাত্যা”/ আউনমাযর ভুলোংফু’ খবং-দ্য তিন-তেঙি সান’ অর্থাৎ ‘আমার আকাঙ্ক্ষার রাঙামাটি;/ অঘ্রানের কাশফুলের ঘোমটা দেযা থুথুড়ে বুড়ি’র মতো। বয়স্ক নারীর পাকাচুলের সঙ্গে ঘোলাটে শাদারঙা কাশফুলের এমন উপমা অসামান্য দ্যোতনা আনে।

২ নম্বর উদ্ধৃতিতেও নিসর্গের ছবি এসেছে সুদূর স্বপ্নচারিতার অনুষঙ্গরূপে। একঝাঁক সোনালি এবং গর্ভিনী যাযাবর হৈমন্তিক বার্গী মেঘের আড়ালে কুয়াশার ঘোমটাপরা পাহাড়ের আড়ালে, যেন স্বপ্নের ভেতরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। কবিমনের সুদূরের প্রতি তৃষ্ণার আকাঙ্ক্ষা এখানে প্রতীকী ব্যঞ্জনা পেয়েছে সাযুজ্যপূর্ণ শব্দসম্ভারে।

৩ নম্বর উদ্ধৃতি একটি জনমনস্তাত্বিক বিষয়কে খোলাসা করে। মানুষের স্বাভাবিক চাওয়া-পাওয়াগুলো যেকোনো কারণে বাধাগ্রস্ত হলে ক্ষোভ ও বেদনার একটি আস্তরণ সৃষ্টি হয় মনের অলিন্দে। আর জনতার সেই বেদনা-ক্ষোভের বিপরীতে উল্লাস-আনন্দে ভাসে যারা, তাদের মনে হয় হিংস, সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী। এই যাপনিক বাস্তবতা ‘মোনঘর’ কবিতাটিতে সাবলীলভাবে ওঠে এসেছে।

৪ নম্বর উদ্ধৃতিতে দীর্ঘদিন কবিতা লিখতে না-পারার কষ্টকর সময়গুলোর কথা এসেছে। একটি উপমায় এখানে বলা হলো সেই রকম এক বিবাহিত নারীর বেদনার কথা, যে-নারী সন্তান জন্মদানের সুখ থেকে বহুদিন ধরে বঞ্চিত।

৫ নম্বর উদ্ধৃতি ধারণ করে নবতারুণ্যের অবদমিত ক্রোধের অনুষঙ্গ। নতুন কিছু নির্মাণের স্বপ্নে বিভোর একঝাঁক তরুণ নিজেদের অনিয়ন্ত্রিত আবেগের আতিশয্যে দিনগুলো পার করছেন হেলায়-ফেলায়। তাদের রাতের আড্ডাস্থলে খিস্তি-খেউড়ের ফানুস ওড়ানো ফুরোলে একসময় যথানিয়মে ভোর আসে ধীর লয়ে। কবি দেখেন, ঝাঁক-ঝাঁক জালালি কৈতর দিকে-দিকে ওড়ে যাচ্ছে তাদের গন্ত্যব্যে বা কাজের সন্ধানে। অস্থির তারুণ্যের মনস্তত্ত্বটি এখানে নিপুণ শব্দে অঙ্কিত হয়েছে বলিষ্ঠ মুনশিয়ানায় ।

৬ নম্বর উদ্ধৃতি দাম্পত্য জীবনের অসুখকর মুহূর্তগুলোর একটি ক্ষণিক উদ্ভাসকে ধারণ করেছে। এখানে হতাশার মলিন চিত্রটি কবির উজ্জ্বল চৈতন্য মনোরম ভাষিক বিভাসে ফুটিয়ে তুলেছে।

৭ নম্বর উদ্ধৃতি কবির অগাধ ইতিহাসজ্ঞান ও তীক্ষ্ণ সমকাল চেতনাকে উদ্ভাসিত করে। এখানে স্বসমাজের প্রতি গভীর ও তীব্রগতির সমালোচনার বল্লমও ছুটে যায় শ্লেষে আর বিদ্রূপে। তাদের ‘মাতাল ঘুম আঁধারের আড়ালে হারিয়ে গেলে’ জ্যোৎস্নায় জাগে অপ-আত্মারা। কারা যেন ‘পুরানো জুমের/ রসালো-সতেজ সবজিক্ষেত’ উন্মুক্ত করে দেয়। আর বহুপতিগ্রহীতা যুবতীরা আলতারঙে নাচঘর উজালা করে তোলে নাচের শব্দে। এখানে সুবিধাদানকারী শ্রেণিটিকে ‘নিয়ানড্যারথাল’ আর সুবিধাগ্রহণে তৎপর শ্রেণিটিকে ‘ম্যামথ’রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর ওই ‘ট্রব্রিয়ান্ড গাভুরীরা’ ওই দুইয়ের ক্রীড়নকরূপে লীলাচঞ্চল হয়ে ওঠে যেন।

৮ নম্বর উদ্ধৃতি আরও কঠিন, স্থবির ও বোধহীন সময়ের চালচিত্র ধারণ করেছে। কবির অনুভূতিতে সময়টা ‘চেরোকেইত নাদংছারা গরুচরা দঙলর আউনমাযর সাদাঙা সময়,’। অর্থাৎ বৈরী সময় কবলিত দিনকাল। সকল ঘরগেরস্তি জুড়ে নিরাশার হাহাকার। অভাব-অনটনের কালো ছায়ারা যেন এখানে ঘোরে হিমের আলাপন’ হয়ে। গরিবের জন্যে খাদ্য ব্যবস্থাপনায়ও ভাগ বসায় ‘পাল-পাল রগনি শালমক’ (রক্তচোষা গিরগিটি)।

৯ নম্বর উদ্ধৃতি কবির পরিত্রাণপ্রাপ্তির পথ নির্দেশ করছে যেনবা। কবিতা রচনা তাঁর কাছে আলোর উল্লাস। উজ্জ্বল পথের দিশা। একটি অব্যর্থ উপমায় এই অভিব্যক্তি সিদ্ধিলাভ করেছে দীপ্রভাবে : “কবিতা ম’র সাঝন্যের জুমতুগুনোত বাক্কো চারিলোই ঘরত ফিরিত্তে/ জুম্মবী চোগর লাঙমেয়্যে বিজোল স্ববন” (কবিতা আমার শীর্ষে কাস্তে হাতে ঘরমুখো/ জুম্মবী চোখের স্বপ্নিল ভালোবাসা; …)

১০ নম্বর উদ্ধৃতি হতাশার বিশাল চোরাবালিতে নিমজ্জিত কবিসত্তার আহাজারিকে ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত করে। সময় বয়ে যাচ্ছে। আসছে সাঁঝ, তারপরের গভীর অন্ধকারের অনিশ্চয়তা নিয়ে। চারদিকে মানুষের পঁচাশবের গন্ধ। মনে হচ্ছে, কঙ্কালের ভারে পৃথিবীটা দুলছে ভৌতিক অবয়ব নিয়ে। একটি বিধ্বস্ত ভূমিতে যেন কবি দাঁড়িয়ে আছেন একা।

চার.

স্বতন্ত্র চাকমা কবিতার জুমভূমিতে সুহৃদ চাকমা একটি উজ্জ্বল, পরিপুষ্ট সদরক ফুল। সমকালীন বিশ্বচেতনা, স্বদেশ ও তার জনমানুষের প্রতি প্রমিত দায়বদ্ধতা, স্বভাবের ভাষাচিন্তন তাঁকে আলাদা ভাবমূর্তিতে প্রতিভাসিত করে। সুহৃদ চাকমা নিঃসন্দেহে চাকমা ভাষা ও সাহিত্যের বলবান কবি। ৮ আগস্ট ১৯৮৮ সালে রাঙামাটি শহরের বাসা থেকে তিরিশ বছর বয়সে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত তিনি কবিতাচর্চা ও সাংস্কৃতিক সাংগঠনিকতায় যুক্ত ছিলেন। রাঙামাটি জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিলের অন্যতম রূপকার সুহৃদ চাকমা সম্বন্ধে প্রবীণ কবি ফেলাজেয়া (প্রমোদ বিকাশ কার্বারি/ পিবি কার্বারি) লিখেছেন : “সুহৃদ চাকমা শুধু একজন শুদ্ধ কবিতাভক্তই ছিলেন না, ছিলেন একজন আধুনিক কবি। মেধায় ও মননে তিনি চাকমা কবিতাকে অনেকদূর নিয়ে গেছেন। সমকালীন বিষয়বস্তুগুলোকে টেনে নিয়ে প্রবল আকর্ষণে কবিতার অনুষঙ্গ করেছেন। নিরলসভাবে নির্মাণ করেছেন কবিতার চিত্রকল্প। তিনি কবিতা রচনাকে শ্রমসাধ্য কাজ মনে করতেন। চিত্রকল্প নির্মাণ ও শব্দায়নের ক্ষেত্রে তাঁর যে উপলব্ধি, ‘বাগী’ কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি পাতা উল্টালেই তা সহজে চোখে পড়ে।”

লেখক: হাফিজ রশিদ খান

তথ্যসূত্র: “আলোর পথ দেখালো যারা”, পৃ. ১০২, রেগা প্রকাশনী-রাঙামাটি, ২০১৭

সূত্র: জাক’র ৪০ বর্ষপূর্তি সংকলন- ২০২১